ঢাকাশুক্রবার , ২১ জানুয়ারি ২০২২
  • অন্যান্য
আজকের সর্বশেষ সবখবর

শুকনো খাল-বিলে মাছ ধরার ধুম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :
জানুয়ারি ২১, ২০২২ ৪:২১ অপরাহ্ণ । ৫১৬ জন

কুমিল্লায় গ্রামীণ জনপদে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিল অভিমুখে

হেমন্তের শেষে আর শীতের শুরুতে কম পানিতে মাছ ধরার উৎসব শুরু হয় গ্রামবাংলায়। বাঙালির এই ঐতিহ্যের রেশ ধরে সমপ্রতি কুমিল্লার বিভিন্ন জলাশয়ে পলো বাওয়ার ধুম লেগেছে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিল অভিমুখে মানুষের ঢল। কারও কাঁধে পলো, আবার কারও হাতে ঠেলা জাল, খুইরা জাল, বাদাই জালসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জড়ো হচ্ছে এক স্থানে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সববয়সী মানুষের উপস্থিতিতে বিলপাড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। এরপর দল বেঁধে বিলের পানিতে নেমে মাছ শিকারের আনন্দে মেতে ওঠেন তারা। এ চিত্র কুমিল্লার ঘুঘরার বিলের। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেই মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠে। সকলেই উড়াইন্যা জাল, ঠ্যালা জাল, উইন্যা, পলো প্রভৃতি নিয়ে এবং শিশু-কিশোররা খালি হাতেই খালে-বিলে নেমে পড়ে। যেখানে হাঁটু পানি সেখানে ঠ্যালা জাল ও পলো নিয়ে মৎস্য শিকারীরা খালে-বিলে নামছে। দুপুর পর্যন্ত চলে মাছ ধরার এই প্রক্রিয়া। পরে নিজেদের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত মাছ হাটবাজারে বিক্রি করে দেয়।

জেলার অধিকাংশ নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, বাঁওড়ের পানি শুকিয়ে গেছে। কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কাদা-পানি থাকা এসব খাল-বিলে রয়েছে নানা প্রজাতির দেশি মাছ। পেশাজীবী জেলা থেকে শুরু করে শৌখিন মৎস্য শিকারিরা এখন নেমে পড়েছেন মাছ শিকারে। পুরো শীত মৌসুমেই গ্রামগঞ্জে মাছ ধরার এই চিত্র চোখে পড়ে। আর মাছ ধরায় সামিল হতে পেরে শিশু-কিশোরদের আনন্দ আর আনন্দ। কাদা-পানিতে সারা শরীর মাখামাখি করে তারা মাছ ধরার আনন্দে বিভোর থাকে। কৈ, শিং, মাগুর প্রভৃৃতি দেশি জাতের জিয়ল মাছই ধরা পড়ে বেশি। তাছাড়া টেংরা, পুঁটি, খইলসা, শোল, টাকি, বোয়াল, চিকরা, বাইন, কাতলা, সিলভার কার্প প্রভৃতি মাছ তো রয়েছেই।

বর্ষাকালে ফিশারিসহ বিভিন্ন জলমহালের মাছ ভেসে গিয়ে ডোবা-পুকুর, খাল-বিল এবং নিচু জালাভ‚মিতে আশ্রয় নেয়। পরে শুকনো মওসুমে সেইসব মাছ ধরা পড়ে। বর্তমানে গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যাচ্ছে এবং অন্যান্য সময়ের তুলনায় দামও এখন অনেক সস্তা। এদিকে কুমিল্লা বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্ন খালে-বিলে অহরহ ছোট ছোট জাল ও চাই (ফাঁদ) দিয়ে ছোট-বড় কই, শিং, মাগুর, ভেদি, বায়লা, পাবদা, চিংড়িসহ দেশি মাছ শিকার দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন না হওয়ায় ওই সব মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ঘুঘরার বিলের এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি তমিজ উদ্দিন বলেন, দেশি কই, শিং, মাগুর, ভেদি, বায়লা, পাবদা, চিংড়ি ইত্যাদি মাছের প্রজননের সময় মা মাছেরা ডিম ছাড়ার জন্য বৃষ্টির পানিতে ভেসে গিয়ে ধান ক্ষেত, ডোবা, নালা, খাল-বিলে আশ্রয় নেয় এবং ডিম ছাড়ে। কিন্তু ছোট ছোট জাল ও চাঁই (ফাঁদ) পেতে ছোট ছোট মাছসহ ডিমঅলা মাছগুলো ধরে অহরহ বিক্রি করছে হাট-বাজারে।

শুক্রবার ভোরে বিলাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে নানা বয়সী মানুষের এক বিরাট মিলনমেলা। দল বেঁধে হাজারো মানুষ বিলে নেমেছেন মাছ ধরতে। সবার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। কেউ পলোতে বোয়াল ধরেছেন, আবার কেউ বা জালে চিতল। এ যেন কোনো হারিয়ে যাওয়া সময়ের দৃশ্য। মাছ ধরতে আসা চান্দিনার পিপুয়া গ্রামের মোসলেম বলেন, অনেকটা শখের বসে মানুষ আসেন মাছ শিকার করতে, কিন্তু দিন দিন ছোট হয়ে আসছে খাল-বিল। প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে মাছের অভয়াশ্রম। বিল-জলাশয় খনন করে মাছের অভয়াশ্রম না বাড়ালে কিছুদিন পর আর মাছও থাকবে না, মাছ ধরার এই উৎসবও আর থাকবে না। জানা গেছে, কালের সাক্ষী ঐতিহ্যময় ঘুঘরার বিলে মাছ শিকারের জন্য বিশিষভাবে খ্যাত। প্রায় শত বছর ধরেই এমন সময় আশপাশের গ্রামের হাজার হাজার মানুষ মাছ ধরে এখান থেকে। কারো পলো, বাওয়া ইত্যাদিতে রুই-কাতলা, বোয়াল, শোল ইত্যাদি মাছ ধরা পড়লেই একসঙ্গে সবাই আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। তখন তাদের মনে আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায় আনন্দের ঢেউ।

 

পুরনো এ্যালবাম থেকে।