ভয়ানক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। প্রতিদিনই রক্ত ঝরছে ক্যাম্পে। এমনকি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তৎপরতার শিকার হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও।
মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের মধ্যে এক শ্রেণির সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং টেকনাফ-উখিয়া এলাকাজুড়ে বিরাজ করছে ভয়াবহ আতঙ্ক। এর চরম প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশি স্থানীয় সাধারণ জনগোষ্ঠীর ওপর। ক্যাম্পের ভেতরে যেমন হরহামেশায় খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে, তেমনি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা বাইরেও স্থানীয়দের আক্রমণ করছে। খুন-জখম বা অপহরণের শিকার হচ্ছেন তারা। এক কথায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত সাড়ে ৫ বছরে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ১৭৩ জন নিহত হয়েছেন। হামলায় আহত হয়েছেন আরও সহস্রাধিক। নিহতদের মধ্যে কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা রয়েছেন। শুধু চলতি বছরেই সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৯ জন। সর্বশেষ গত শুক্রবার ভোরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা এবং আরএসও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলিতে ৫ জন নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে আরসার তিনজন ও আরএসও সদস্য ২ জন বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ক্যাম্পের বাইরেও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে স্থানীয় অনেক সাধারণ মানুষও হতাহতের শিকার হয়েছেন। এমন ভয়ানক প্রেক্ষাপটে গত শনিবার দুপুর থেকে র্যাব, এপিবিএন ও জেলা পুলিশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীবিরোধী যৌথ অভিযান শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে খুনোখুনিতে ক্যাম্পজুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাধারণ রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ড ও সশস্ত্র হামলার নেপথ্যে ক্যাম্পকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা, অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ন্ত্রণই মূল কারণ। এ ছাড়াও চাঁদাবাজি, স্থানীয়দের অপহরণ, রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ ও ক্যাম্পে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোহিঙ্গা মাঝিদের কয়েকজন সময়ের আলোকে জানান, ক্যাম্পে আরসা-আরএসও সদস্যদের মধ্যে বর্তমানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চরম আকার ধারণ করেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের পর আরসার সদস্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা ও বিরোধী সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর ওপর হামলা চালাচ্ছে।
অপরদিকে ক্যাম্পে অবস্থান করা আরএসও এবং অন্যান্য সন্ত্রাসীগোষ্ঠী এক হয়ে আরসাকে দমনে জোটবদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ থাকায় আরসার প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনির গ্রুপ থেকে সরে আসারও চেষ্টা করছে অন্য একটি অংশ। আর এ অংশকে নিজেদের দলে ভেড়াতে চাইছে আরএসও। এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। আবার ক্যাম্পের অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাও আরসা সন্ত্রাসী দলের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে গোপনে আরএসওকে সমর্থন দিচ্ছে।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ড. হাসান-উল হায়দার সময়ের আলোকে বলেন, অন্ধকারের মধ্যে কাঁটাতার ভেদ করে বাইরে থেকে সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ওই অস্ত্র দিয়েই দুই গ্রুপ আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, আমরা ক্যাম্পে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। ক্যাম্পগুলো এপিবিএনের দখলে। তারপরও খুপড়ি ঘরে সাধারণ রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে বৈরি আবহাওয়ার সুযোগে পরিকল্পিতভাবে হামলা ও হত্যার ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যখন বৃষ্টি হয় তখন ক্যাম্পে টহল দেওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। ওই সুযোগেই সন্ত্রাসীরা ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শুক্রবার রাতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ শুধু নিরাপত্তা ঝুঁকিতেই পড়েনি, অর্থনৈতিক ঝুঁকিও বাড়ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে (মিয়ানমার) নিরাপদ প্রত্যাবাসনকে এর সমাধান বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর কিছুদিন আগে উখিয়ায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাত ও গুলিতে ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা বা হেড মাঝিসহ চারজন নিহত হন। গতকালও ছুরিকাহত হয়ে এক নারী রোহিঙ্গা নিহত হন। এসব ঘটনায় তল্লাশি চালিয়ে মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অস্ত্র ও সন্ত্রাসীদের আটক করলেও কোনোভাবেই দমন করা যাচ্ছে না সন্ত্রাসীদের।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সময়ের আলোকে বলেন, স্বার্থগত কারণে সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর ঢুকে হামলা নাশকতা করছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পেয়েছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠী তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে অপর সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে দমাতে অস্ত্র ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, এর পেছনের বা নেপথ্যের মূল কারণই হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র মাদক কেনাবেচা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে হামলা, নাশকতা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, আমরা এর আগেও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানে গিয়ে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছি। শনিবার থেকে যৌথ অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো নির্যাতন-নিপীড়নের তথ্যানুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম আসাদ আহমাদ খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। আইসিসি টিম চলে যাওয়ার একদিন পর গোলাগুলির এ ঘটনাকে ঘিরে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সাধারণ রোহিঙ্গাদের দাবি, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে গঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। এর মধ্যে আরএসও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার বিষয় ও অধিকার নিয়ে কাজ করে থাকে। আর ক্যাম্পে অপরাধমূলক কর্মকা- করছে আরসা। আরসার নিয়ন্ত্রণে থাকা সন্ত্রাসীরা মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ইন্ধনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে কাজ করছে। প্রত্যাবাসনে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে হত্যা ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একাধিক এপিবিএন সদস্য ও রোহিঙ্গাদের কয়েকজন বলেন, শুক্রবার ভোরে আরসার অন্তত ৪০-৫০ জনের একটি সশস্ত্র দল ক্যাম্প-৮ ওয়েস্টে ঘুমন্ত আরএসও সদস্যদের ওপর হামলার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু আরএসওর সদস্যরা আগে থেকে এ হামলার খবর পেয়ে ভারী অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়। ভোর ৫টার দিকে আরসার সদস্যরা ক্যাম্পে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চারদিক থেকে ঘিরে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে আরএসওর সদস্যরা। এতে দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী গুলিবিনিময় হয়। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে দুই পক্ষই পালিয়ে যায়।
জানা যায়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিচ্ছিন্নতাবাদী দুটি সংগঠন আরসা ও আরএসও সদস্যদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। ফলে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সংঘর্ষ, খুন, অস্ত্র, মাদক চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধ হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও পিএসসির সদস্য ড. দেলোয়ার হোসাইন সময়ের আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠী কেএনএফ, আরসা, আরএসও বান্দরবান ও কক্সবাজার এলাকায় কেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার নেপথ্য কারণগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। এসবের পেছনে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কোনো ইন্ধন আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে।
ড. দেলোয়ার হোসাইন বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের দিক থেকে সর্বোচ্চ মানবিকতা দেখানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের স্নায়ুবিক মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। এ অবস্থার মাঝেও রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে চীন। কূটনৈতিক তৎপরতায় চীনের সহযোগিতা নিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে ত্বরান্বিত করতে হবে। পাশাপাশি আরও দৃঢ়ভাবে বিশ্ব দরবারে রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ সময়ের আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থে ও দ্বন্দ্বে অস্ত্রের মহড়া, গোলাগুলি বা হতাহতের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। তাতে প্রধান সমস্যাটা হলো ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ভূমিতে বসে তারা ঘটাচ্ছে। নিরীহ রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে তারা। এ ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার দায় আমাদের (বাংলাদেশ) ঘাড়ে এসে পড়ছে, শুধু রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে। তিনি বলেন, মূলত রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া (প্রত্যাবর্তন) ঠেকাতে বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই সন্ত্রাসীরা এসব অরাজকতা করে যাচ্ছে। এর নেপথ্যে বড় ধরনের উদ্দেশ্য কাজ করছে। রোহিঙ্গা কক্সবাজারে থাকলে কার লাভ, কার ক্ষতি সেটা বিশ্লেষণ করলেই নেপথ্যের কারণ বোঝা যাবে।
আবদুর রশীদ বলেন, যেসব সংস্থা বা এনজিও সেখানে কাজ করছে তাদের দিকেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। এ সব জটিল অবস্থার মধ্যে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। তাদের কর্মকা-ের দিকে আরও বেশি নজরদারি বাড়াতে হবে। এ ছাড়াও ক্যাম্পের ভেতরে অর্থের যে সরবরাহ আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটি যে কোনোভাবে বন্ধ করতে হবে। ওই অর্থ সংগ্রহের উৎস হলো অবৈধ অস্ত্র ও মাদকসহ চোরাচালান। অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারাও প্রভাবিত হচ্ছে।
রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এ ছাড়া ক্যাম্পগুলোতে প্রতি বছর ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। এ হিসাবে ৫ বছরে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে। ফলে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১২ লাখের বেশি। বিশাল এ জনগোষ্ঠীতে আরসা, আল ইয়াকিনসহ অন্তত ১৫টি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন সক্রিয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন অপরাধী চক্রের নেতৃত্বে চলে মাদক কারবার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ। এমনকি আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র মহড়া, অপহরণ, মানবপাচার, সংঘর্ষেও জড়াচ্ছে তারা। পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তারের জেরে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষসহ একের পর এক হত্যাকাণ্ড।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এপিবিএন তথ্য বলছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১ হাজার ১৬৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতার হন ১ হাজার ৬৮৫ রোহিঙ্গা। এগুলোর মধ্যে ৪১টি হত্যা মামলা, ৪০টি অপহরণ মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলায় ১১টি ও ৯৭টি অস্ত্র মামলা। তবে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদক সংক্রান্ত ৯৭৮টি।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অতি সম্প্রতি উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার ক্যাম্প অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। সম্প্রতি মাদকের বড় চালানগুলো বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকেই জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোয়েন্দাদের ভাষ্য, বালুখালী এই স্থানটিই মাদক ও চোরাচালানের জন্য নিরাপদ রুট হিসেবে পরিচিত। এই পয়েন্টেই আরসার ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দিয়েছে যৌথবাহিনী। এরপর থেকে আরএসও এই পয়েন্টটি দখলে নিতে মরিয়া হয়েছে। যৌথবাহিনীর অভিযানে আরসার সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পের ভেতরই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। এরপর সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। যৌথবাহিনীর অভিযানের পর মূলত আরসার সদস্যরা দুর্বল হয়ে পড়ে। অপরদিকে আরএসও সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ক্যাম্পের ভেতর তাদের আধিপত্য গড়ে তোলে। ৩৩টি ক্যাম্পেই আরএসও সদস্য রয়েছে। সব ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে। কোণঠাসা হওয়া আরসার সদস্যরাও তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে অস্ত্র-মাদক বিক্রি এবং স্বর্ণ চোরাচালান করে তাদের দল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে অনেকটা কোণঠাসা হওয়ার পর আরসার সদস্যরা গোপনে হামলার ঘটনা ঘটায়।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে যেসব অপরাধে জড়িত ছিল এখনও সেই ধরনের অপরাধ করছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারামারি, সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এমনকি খুন, মাদক, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে অনেক রোহিঙ্গা। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
নিহত ৫ জনের পরিচয় মিলেছে : গত শুক্রবার গোলাগুলিতে নিহত পাঁচজনের পরিচয় মিলেছে। তারা হলেন-আরসা কমান্ডার আনোয়ার সাদেক (২৩)। তার পিতা মৃত আবুল কাছিম। তিনি এফসিএন নম্বর ৪৫০৫৩৪, ব্লক-এইচ/৪৯ ক্যাম্প-৮/ওয়েস্ট বাসিন্দা। মো. হামিম (২১), পিতা জকরিয়া। এফসিএন নম্বর ১২৩১৯৩। ব্লক-এ/২১, ক্যাম্প-৮/ওয়েস্ট। আরেকজন অজ্ঞাত (২৫)। অপরদিকে আরএসওর নিহত নেতার নাম নজিমুল্লাহর (২৬)। পিতা আবদুল কাদের। ব্লক-এইচ/৪২ ক্যাম্প-১০। নিহত নুরুল আমিনের (২৪) পিতার নাম বৈদ্য বশর। তিনি ব্লক-বি/১৭ ক্যাম্প-৩ এর। এ ছাড়াও আহত ইমান হোসেন (৪৫) বর্তমানে চিকিৎসাধীন। তার পিতার নাম নোমাল হাকিম। তিনি এফসিএন নম্বর ৩০৩২৭৫, ব্লক-আই/২ ক্যাম্প-৯ এর বাসিন্দা। তাকে পুলিশি হেফাজতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।