ঢাকামঙ্গলবার , ৪ জুলাই ২০২৩
  • অন্যান্য
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ফাঁসির মঞ্চ থেকে যেভাবে কারামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা!

নিজস্ব প্রতিবেদক :
জুলাই ৪, ২০২৩ ১২:১৩ পূর্বাহ্ণ । ১৮৭ জন

কুমিল্লায় মৃত্যুদণ্ড মওকুফ পাওয়া সেই মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্রের ৩০ বছর পর মুক্তি ২০০৮ সালের ৭ এপ্রিল রাত ১১টায় একটি হত্যা মামলায় ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষও ফাঁসির যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। রাখাল চন্দ্র নাহা গোসল করে হালকা শুকনো খাবার খেয়ে ফাঁসির সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। রাত ১১ টায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাত্র দেড় ঘন্টা পূর্বে কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির দন্ডাদেশ মওকুফের ওয়ারলেস বার্তা পান। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিনের নিকট আবেদন করলে রাষ্ট্রপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার মৃত্যুদন্ডাদেশ মওকুফ করে ৩০ বছর সাজা বহাল রাখেন। ৩০ বছর অন্ধকার কারাগারে থাকার পর রবিবার (২ জুলাই) সকালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মৃত অক্ষয় চন্দ্র নাহার ছেলে বীর মুক্তিযুদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে। তার মুক্তির খবরে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে।

মামলার বিবরণে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে জমি জমা নিয়ে পূর্ব শত্রুতার জেরে জেঠাতো বোনের জামাই দীনেশ চন্দ্র দত্তকে হত্যার অভিযোগে বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহা ও তার ভাই নেপাল চন্দ্র নাহার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করে দীনেশের পরিবার। মামলার পর রাখাল চন্দ্রকে আটক করা হলেও নেপাল চন্দ্র নাহা কয়েক বছর পলাতক থাকার পর মারা যান। ওই মামলায় ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। পরে ওই মৃত্যুদন্ড মওকুফ করার জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ কাছে দাবি জানান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবির, সাবেক সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমেদসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীরা। এরপর ২০০৮ সালের ৩০ জুন তার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন সাজা দেন রাষ্ট্রপতি।
মুক্তি পেয়ে সোমবার সকালে রাখাল চন্দ্র নাহা গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ভগবান আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমার মৃত্যুদন্ড মওকুফের খবর পেয়ে পুরো কারাগারেও আনন্দ করেছে অন্য কয়েদী ও সাধারণ আসামীরা। সবাই জানতো রাতে আমার ফাঁসি কার্যকর হবে। এজন্য দিনের বেলাও অনেক আসামী ও কয়েদী পুলিশ আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। রাত ১১ টায় আমার ফাঁসির সময় দেওয়া হয়েছে। আমি গোসল ও হালকা শুকনো খাবার খেয়ে সেলে বসে ছিলাম। বুক তখন ধরফর করে কেপে উঠছিল, চোখে মুখে বাঁচার আকুতি ছিল, সেলে কেউ আসলেই মনে হতো এই বুঝি আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে নিয়ে যেতে এল! কারা পুলিশ আমাকে শেষ খাবার খাওয়াতে এসেছিলো, আমি কিছুই খাইনি। একটু পর পর ডাক্তার আসে শরীর পরীক্ষা-নিরিক্ষা করতেন। আমার বুক ধরফর করতে দেখে আমাকে বলেছিল আমি যেনো শান্ত থাকি। মৃত্যুদন্ডের দেড় ঘন্টা আগে এক কারা পুলিশ এসে আমাকে জানায় রাষ্ট্রপতি নাকি আমার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেছে। আমি সে দিন আনন্দে চিৎকার দিয়েছিলাম। বিনা অপরাধে অন্ধকার কারাগারে ৩০ টি বছর পার করেছি। কারাগারের একদিন ছিল আমার কাছে ১ হাজার বছরের মত। যেদিন দীনেশ কে হত্যা করা হয় সেদিন আমি বাড়ি ছিলাম না, আমার সম্পত্তি ভোগ দখল করার জন্য আমাকে দীনেশ হত্যায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। আমি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। এ দেশই আমাকে বিনা কারণে ৩০ বছর কারাগারে রেখেছে।

রাখাল চন্দ্র নাহার স্ত্রী গীতা রানী নাহা বলেন, যখন আমার স্বামী জেলে যায় তখন আমার বয়স ছিল ২৫ বছর। এখন আমার বয়স ৬৫ বছর। একটি মিথ্যা মামলায় আমার সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি সন্তানদের ছেড়ে কোথাও যাইনি। এ সংসার আঁকড়ে রেখেছি। আর আমার স্বামী কবে মুক্তি পাবে সে অপেক্ষা করছিলাম। আমি তাকে ৩০ বছর পর কাছে পেয়েছি। এ বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি আরও বলেন, আমার চার সন্তানের মধ্যে কেউ শিক্ষিত নয়। তাদের বাবা জেলে যাওয়ার পর অর্থের অভাবে কাউকে লেখা পড়া করাতে পারিনি। আমার স্বামী জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছে আমি অনেক খুশি।

আমরা মুক্তিযুদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. হুমায়ন কবির বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহা হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত ছিলেন না। তাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসিয়ে হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। পরে আমারা আন্দোলন করে তার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করাই।

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, জমি জমা নিয়ে পূর্ব শত্রুতার জেরে জেঠাতো বোনের স্বামী দীনেশ চন্দ্র দত্তকে খুনের অভিযোগে গত ১৯৯৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বন্দি অবস্থায় কারাগারে আসেন রাখাল চন্দ্র নাহা। তার (কয়েদি বন্দি নং- ৪১৮৯/এ)। ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারী তার মৃত্যুদণ্ড আদেশ দেওয়া হয়। পরে ২০০৮ সালের ৩০ জুন তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ সংশোধিত হয়ে যাবজ্জীবন সাজা হয়। তার অর্জিত রেয়াত ছিল ৫ বছর ৭ মাস ২ দিন। ২ জুলাই সকালে সাজার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, রাখাল চন্দ্র নাহা প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করলে তার আবেদন নামঞ্জুর হয়। পরে ২০০৮ সালের ৭ এপ্রিল রাত ১১ টায় তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার কথা ছিল। ওইদিন ফাঁসির দন্ডাদেশ কার্যকর করার মাত্র দেড় ঘন্টা পূর্বে রাত সাড়ে ৯টায় তৎকালীন সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমেদের সুপারিশে যারা দেশ স্বাধীন করেছেন তাদের ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে ফাঁসি হতে পারেনা এই মর্মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিনের নিকট আবেদন করলে রাষ্ট্রপতি তার মৃত্যুদন্ডাদেশ মওকুফ করে ৩০ বছর সাজা দেন।